মুসলিম সমাজ আজ দুর্নীতি, দুরাচার, খুন-খারাবি, অন্যায়-অপকর্ম, পাপ-পঙ্কিলতার মধ্যে নিমজ্জিত। এদেশের শিক্ষিতরাই বেশি দুর্নীতি করে থাকে। খুনের রাজনীতিতে তারাই জড়িত। নিজের স্বার্থ হাছিলের জন্য আপন ভাই এমনকি পিতা-মাতার গলায় ছুরি চালাতেও তারা কুণ্ঠাবোধ করে না। শিক্ষিতের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে, কিন্তু বাড়ছে না প্রকৃত শিক্ষিতের সংখ্যা। ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে অশান্তি আর অরাজকতা। পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে ছাত্র সমাজের নানা অন্যায়-অনৈতিকতা এবং তাদের অপরাধ প্রবণতার কথা। মদ, গাঁজা, ইয়াবা, ছিনতাই, অপহরণ, ধর্ষণ, গুম-খুন ইত্যাদির মত জঘন্য অপরাধের সাথে তাদের সম্পৃক্ততার খবর। তারাই তো নেতার নির্দেশে উন্মুক্ত অস্ত্র হাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ত্রাস সৃষ্টি করে। তৈরী করে শিক্ষার অনুপযুক্ত পরিবেশ। অবশেষে তারাই শিক্ষার বড় বড় ডিগ্রী নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে এবং সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় ভূমিকা রাখে। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই তারা তাদের লালিত নোংরা আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকে। তাই তো সমাজের আজ এই করুণ পরিণতি! সম্মানিত সুধী! আমরা মনে করি, উপর্যুক্ত পরিস্থিতি থেকে মুসলিম জাতিকে উদ্ধার করতে পারে একমাত্র দ্বীনী শিক্ষা। কেননা আধুনিক শিক্ষা দুনিয়ায় সমৃদ্ধি আনয়ন করলেও সুখ ও শান্তি সেখানে থাকে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। পক্ষান্তরে দ্বীনী শিক্ষা একজন মানুষের দুনিয়া ও পরকাল উভয় জীবনকে করে তোলে সমৃদ্ধশালী। মানুষের শারীরিক চিকিৎসার জন্য যেমন ডাক্তারের প্রয়োজন হয়, তেমনি অপরাধপ্রবণ বস্তুবাদী মানুষগুলোকে সুস্থ করার জন্য প্রয়োজন হয় ধর্মীয় ডাক্তারের। আধুনিক শিক্ষার ফল সাময়িক ও অনেক ক্ষেত্রে তা মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত। পক্ষান্তরে, দ্বীনী শিক্ষার ফলাফল স্থায়ী ও সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, যা দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ বয়ে আনে। অতএব, সমাজে শান্তির জন্য দ্বীনী শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। ধর্মীয় বা দ্বীনী শিক্ষাই হচ্ছে আসল শিক্ষা। আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, আমাদের দেশে যেমন হাদীছ গ্রন্থের পর্যাপ্ত বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়নি, তেমনি ইসলামের বিভিন্ন দিক ও বিভাগের উপর সুন্দর এবং মৌলিক গ্রন্থও রচিত হয়নি। বর্তমানে রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনীগ্রন্থ ছাড়া ইসলামের ইতিহাসের উপর গ্রহণযোগ্য ও পূর্ণাঙ্গ কোনো বই পাওয়া যায় না। ইসলামী অর্থনীতির উপর গ্রন্থ তো শূন্যের কোঠায়। তাছাড়া কুরআনের তাফসীর, হাদীছের তাহক্বীক্ব, ব্যাখ্যা, ফাতওয়া সংকলন এগুলোর অবস্থা তো আরও করুণ। আপনি বলতে পারেন, তাহলে এতদিন থেকে দেশের মাদরাসাগুলো কী করেছে? সত্যি বলতে কি মাদরাসাগুলোতে শিক্ষার ক্ষেত্রে সৃজনশীলতার অভাব আছে। ধর্মীয় গোঁড়ামি আর পূর্বপুরুষদের আদর্শের দোহাই দিয়ে কুরআন-হাদীছকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ইসলামকে নিজের মন মত করে বুঝার অপচেষ্টা এখনও চলছে। ইসলামের নামে বিভিন্ন ভ্রান্ত ফের্কা আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষকে ইসলামবিমুখ করার ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। এক শ্রেণির আলেম প্রকৃত ইসলামকে শিরক-বিদ‘আত দ্বারা কলুষিত করার ঘৃণ্য কর্মে লিপ্ত আছে। তাইতো এদেশে বিভিন্ন মাযার-খানকা-দরগা গড়ে উঠেছে। যার মাধ্যমে সরলমনা মুসলিম জনসাধারণকে একদিকে যেমন ঈমান শূন্য করা হচ্ছে, অন্যদিকে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সেগুলোকে জমজমাট ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত করেছে। মূলত পীর-মুরিদীর নামে চলছে বিনা পুঁজির লাভজনক ব্যবসা। এগুলো সবই প্রকৃত দ্বীনী শিক্ষা না থাকার ফল। সুতরাং এদেশে প্রয়োজন এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যা সাড়ে চৌদ্দশত বছর পূর্বের শিরক-বিদ‘আত মুক্ত ইসলামকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করবে। যে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা হবে সত্য ও ন্যায়ের উজ্জ্বল নক্ষত্র। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আদর্শে উজ্জীবিত দুর্জয় কারী। সালাফে-ছালেহীনের আদর্শের ধারক-বাহক এবং ইসলামের বিশুদ্ধ আক্বীদাহ রক্ষার অতন্দ্রপ্রহরী। তারা মানুষের কল্যাণে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করবে। কথা, কলম ও মিডিয়ার মাধ্যমে ইসলামের খিদমাতে ভূমিকা রাখবে। তারা আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে ইসলামের জন্য ব্যবহারে কৌশলী হবে এবং ইসলাম বিদ্বেষীদের অপব্যাখ্যার উপযুক্ত জবাবদানে সক্ষম হবে। একবিংশ শতাব্দীতে ইসলাম বিরোধী যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে। সমকালীন জীবনের যে কোনো চাহিদা পূরণে তারা হবে পূর্ণ পারদর্শী। মিথ্যা ও ভ্রান্তি থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে মুক্তিকামী মানুষের আস্থার প্রতীক। প্রগতি ও অবাধ স্বাধীনতার বিষাক্ত ছোবলে আক্রান্ত জনতাকে তারা মুক্তির মোহনায় পৌঁছিয়ে দেবে এবং পাপ-পঙ্কিলতা আর অন্যায়ে নিমজ্জিত জনগোষ্ঠীকে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় দেবে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে লেখক, গবেষক, বাগ্মী বের হবে এবং কুরআন ও ছহীহ হাদীছের পতাকা নিয়ে দেশে-বিদেশে ছুটে বেড়াবে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রতিটি ঘরে ঘরে সত্যিকার ইসলামের দা‘ওয়াত পৌঁছানোর বিরামহীন প্রচেষ্টা চালাবে। তাই শায়খ আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ এরকমই প্রতিষ্ঠানের স্বপ্ন নিয়ে ২০১৩ সালের ২৪ আগস্ট হাটাব, বীরহাটাব-বিরাব, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জে এবং ২০১৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ডাঙ্গীপাড়া, পবা, শাহমখদুম, রাজশাহীতে মানসম্মত ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে ‘আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ’ নামে বালক ও বালিকা শাখা সম্বলিত পৃথক পৃথক দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
১. পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের জ্ঞানার্জন এবং তদানুযায়ী আমলের মাধ্যমে ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি লাভ।
২. সালাফে ছালেহীনের মাস্লাক অনুসারে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান।
৩. ইসলামের নির্ভেজাল রূপ জনগণের সামনে তুলে ধরা এবং ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের যথাযথ জবাবদানের জন্য আল্লাহভীরু যোগ্য আলেম, লেখক, গবেষক, অনুবাদক, দাঈ ও বাগ্মী তৈরি করা।
৪. সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এবং সকল অবস্থায় মুসলিম জাতিকে সঠিক দিক-নির্দেশনা দানের জন্য উপযুক্ত নেতৃত্ব তৈরি করা।
৫. মুসলিমদের মধ্যকার বিশেষ করে বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের মাঝে ইখতিলাফ ও ইফতিরাক দূর করা। এক কথায় ‘ইত্তিহাদে উম্মাহ’ তথা মুসলিম ঐক্যের প্রচেষ্টা চালানো।
জামি‘আহ-র শিক্ষা কোর্স
জামি‘আহ-র শিক্ষা কোর্স মোট ৬ স্তরে বিভক্ত হবে।
১. নূরানী (১ম-২য়) = ২ বছর
২. ইবতেদায়িয়্যাহ (৩য়-৫ম) = ৩ বছর
২. মুতাওয়াসসিতা (৬ষ্ঠ-৮ম) = ৩ বছর
৩. ছানাবিয়্যাহ (৯ম-১০ম) = ২ বছর
৪. আলেমিয়্যাহ (একাদশ-দ্বাদশ) = ২ বছর
৫. ফাযিলা/দাওরা (স্নাতক) = ২ বছর
বৈশিষ্ঠ্যসমূহ:
১. দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান সমূহের উন্নত সিলেবাসের সমন্বয়ে প্রণীত নির্ধারিত নিজস্ব সিলেবাসের আলোকে পাঠদান।
২. দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রীপ্রাপ্ত দক্ষ, অভিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ, পরিশ্রমী ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকমন্ডলী দ্বারা পরিচালিত।
৩. আবাসিক হল সর্বদা শিক্ষকমন্ডলী দ্বারা তত্ত্বাবধানের সুব্যবস্থা।
৪. দৈনিক তিনবার ‘আদর্শ খাবার’ তথা নিরামিষের পাশাপাশি আমিষজাতীয় খাবারের ব্যবস্থা।
৫. কুরআন ও হাদীছের উপর গভীর জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি আরবী ও ইংরেজি ভাষার পূর্ণ দক্ষতা অর্জনের সুযোগ।
৬. স্বাস্থ্যসম্মত মনোরম পরিবেশ ও শরীর চর্চার জন্য উন্মুক্ত বিশাল খেলার মাঠ।
৭. গভীর নলকূপের মাধ্যমে আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা।
৮. সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের ব্যবস্থা।
৯. নির্দিষ্ট ক্লাসে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের জন্য কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। (প্রস্তাবিত)
১০. আরবী, বাংলা ও ইংরেজি বই সমৃদ্ধ লাইব্রেরি।
১১. ক্লাস পরবর্তী কোচিং-এর বিকল্প হিসাবে আবাসিক শিক্ষকমন্ডলী কর্তৃক শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার সার্বক্ষণিক তদারকীর সুব্যবস্থা।
১২. সুপ্ত মেধা বিকাশের জন্য ‘কো-কারিকুলাম’ কার্যক্রম পরিচালনা।
১৩. আরবী, বাংলা ও ইংরেজিতে কথোপকথন ও বক্তৃতাদানের দক্ষতা অর্জনের জন্য পৃথক প্রশিক্ষণের তথা সাপ্তাহিক ইসলাহুল বায়ানের ব্যবস্থা।
১৪. প্রতি বছর একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রণয়ন এবং তার সাথে সমন্বয় করে পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন।
১৫. স্বাস্থ্যসম্মত, সুন্দর ও উন্নতমানের আবাসিক হলের সুব্যবস্থা।
১৬. বিশুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত ও হিফযের ব্যবস্থা।
১৭. সমাপনী, জে.ডি.সি, দাখিল ও আলিম পরীক্ষার জন্য বিশেষ তত্ত্বাবধান।
১৮. উপস্থিত বক্তৃতা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন।
১৯. অমনোযোগী শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা তত্ত্বাবধান।
২০. প্রচলিত রাজনীতিমুক্ত নিরাপদ পরিবেশ।
২১. নিয়মিত খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, বার্ষিক ক্রীড়া ও গ্রন্থপাঠ প্রতিযোগিতা।
২২. প্রাথমিক চিকিৎসার সুব্যবস্থা।
পাঠ্যক্রম:
বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড, উপমহাদেশের বিখ্যাত ক্বওমী প্রতিষ্ঠানসমূহ ও মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসসমূহের সমন্বয়ে প্রণীত পৃথক সিলেবাস।
বক্তব্য প্রশিক্ষণের বিশেষ কর্মসূচী:
প্রতি সপ্তাহে বক্তব্য প্রশিক্ষণের ক্লাস হবে এবং এটি প্রতিষ্ঠানের আবশ্যিক ক্লাস হিসাবে গণ্য হবে। এই প্রশিক্ষণে বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রতিটি শিক্ষার্থীকে পর্যায়ক্রমে বাংলা, ইংরেজি ও আরবীতে বাধ্যতামূলকভাবে বক্তব্য দিতে হবে। এসব বক্তব্যের উপর নম্বর থাকবে, যা পরীক্ষার ফলাফলের সাথে যুক্ত হবে। বক্তব্যের মান অনুযায়ী নম্বর প্রদান করা হবে। এসব বক্তব্য প্রশিক্ষণ ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকলে সে কোন নম্বর পাবে না, যা তার পরীক্ষার ফলাফলে প্রভাব ফেলবে। বক্তব্য প্রশিক্ষণের জন্য ৫০ নম্বর নির্ধারিত থাকবে।
উন্নত চরিত্র গঠনের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ:
চরিত্র মানুষের অমূল্য সম্পদ। শিক্ষার অন্যতম মৌলিক উদ্দেশ্য উন্নত চরিত্র গঠন। তাই জামি‘আহ শিক্ষার্থীদের সুন্দর চরিত্র গঠনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সে কারণে উত্তম আদর্শ ও উন্নত চরিত্রের উপর ৫০ নম্বর নির্ধারিত থাকবে, যা পরীক্ষার ফলাফলের সাথে যুক্ত হবে। উল্লেখ্য, বক্তব্য প্রশিক্ষণ তথা ইছলাহুল বায়ান এবং উন্নত চরিত্র গঠন তথা আমল-আখলাক্ব উভয় মিলে ক্লাসের অন্যান্য বিষয়ের মত একটি আলাদা বিষয় হিসাবে গণ্য হবে।
নিবরাস ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন কর্তৃক পরিচালিত